লেখক হুমায়ূন আহমেদ তার বইয়ের উৎসর্গ পত্রে একটা…

লেখক হুমায়ূন আহমেদ তার বইয়ের উৎসর্গ পত্রে একটা গল্প লেখছিলেন হুমায়ুন ফরিদী নিয়া। ফরিদীর সাথে একদিন সুবর্ণা মুস্তাফার ঝগড়া হলো। তারা তখন জামাই বউ। সুবর্ণা মুস্তাফারে তো চিনেন? গোলাম মুস্তফার মেয়ে।

সেই ঝগড়ার পরে মুস্তাফার মেয়ে মুস্তাফা রাগ করে দরজা বন্ধ করে ঘুমাইয়া থাকলেন। আর ঘুম থেকে উঠে দেখলেন ফরীদি সারা ঘরে, মেঝেতে দেয়ালে, সর্বত্র লিখে রাখছেন, সুবর্ণা আমি তোমাকে ভালোবাসি।

এই গল্প বইলা পাতলা তথা অগভীর দুইটা ফিলোসফি বিলাইতে চান সাধারণ লোকেরা।

নাম্বার ওয়ান, ফরীদি সেরা প্রেমিক ছিলেন। ওইটাই আসল প্রেম। পরোক্ষে এই কথাও উহ্য থাকে সুবর্ণা খারাপ তথা মেয়েরা স্বার্থপর। পেরেম বুঝে না। এইজন্যই তিনি পরে ইয়াং পোলা সৌদ সাবরে বিয়া করে। ভদ্রলোক নাটক ফিলিম নির্মান করেন।

হুমায়ূন ফরীদির মতো সুবর্ণাও জনপ্রিয়, ধরা যায় সমানে সমানে, আরবান সমাজের কাছে। নাইলে তারে আরো বেশি আক্রমণ করা হইত।

নাম্বার টু, তারা বলতে চান, মানুষ কেমনে সময়ের লগে লগে বদলায়। তারা সুবর্ণারে ইঙ্গিত কইরাই কথাটা বলেন। বা তাদের সম্পর্করে দেখাইয়া। মানে আগে কী ছিল হায়রে, আর পরে কী হইল। মুনীর চৌধুরী তার নাটক রক্তাক্ত প্রান্তরের সুজাউদ্দৌলারে দিয়া বাংলাদেশী শিক্ষিত সমাজে আরেকটা আইডিয়া ঢুকাইয়া দিছেন, মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়। সাধারণ লোকেরা এর সাথে মিল রাইখাই গলা মিলান।

আমার লেখার উদ্দেশ্য দুইটাই যে ভুল, এবং মানুষের বাস্তব লাইফের সাথে অত কানেক্টেড না, সেইটা দেখানো।

আমার সম্বল হুমায়ূনের ঐ ভূমিকা, অবজার্ভেশন আর মগজাস্ত্র!

প্রথম পয়েন্ট। হুমায়ূন ফরীদি যে দরোজায়, মেঝেতে আই লাভ ইউ সুবর্ণা লেইখা রাখছিলেন, এইটা শুনতে রোমান্টিক শুনাইলেও অবসেসিভ একটা আচরণ। কিছুটা ভয়ংকর ব্যাপার স্যাপারের ইঙ্গিত দেয়।

প্রেম কখনো মানুষরে এইরকম আচরণ করায়। কারণ ঐসময় নিশা করলে যেমন মানুষ ভারসাম্য হারায়, তেমনি ভারসাম্যলেসনেসে চলে যাইতে পারে। কিন্তু তাও, এই ব্যাপারটি ফরীদির চরিত্রের একটা দিকরে দেখায়। তার অবসেসিভ একটা ব্যাপার ছিল। হয়ত আরো অনেক ব্যাপারেও এইটা ছিল।

যেমন ধরি একজন লোক তার লেখা নিয়া অবসেসিভ। আবার তার বউরে ভালোওবাসে। কিন্তু দুইটার দ্বন্দ্ব উপস্থিত হইতে পারে। তখন সে ধরা যাক বেশি অবসেশনের জায়গা লেখারেই বাইছা নিল। এই জিনিস বউয়ের সাথে তার ঝামেলার সূত্রপাত করতে পারে।

মেঝেতে লেখা যেমন সে কন্ট্রোল করতে পারে নাই, যেমন অন্য অবসেশনগুলাও হয়ত কন্ট্রোল করতে পারবে না।

পিরীত মানে কী? আপনে যদি ভাবেন একদিন ঝগড়া কইরা মেঝেতে আই লাভ ইউ লেইখা রাখা, তাই এই ভাববাদী পিরীত বাস্তব জীবনে পাইবেন না। হতাশ হইবেন, এবং সম্পর্ক টিকাইতেই মেঝেতে গড়াগড়ি খাইতে হইতে পারে।

পিরীত মানে হইল, একটা দীর্ঘকালীন সহাবস্থানে, মিলাইয়া মিশাইয়া চলে। অর্থাৎ, দুইজনের বুঝাপড়া ইত্যাদি। এইটা খুবই বোরিং। এবং খুবই আন-রোমান্টিক সময়ে সময়ে। মাঝে মাঝে রোমান্টিকতা থাকতে পারে। কিন্তু মোটের উপর এই। সেই বুঝের জায়গায় মিশ না খাইলে, যতই মেঝেতে আই লাভ ইউ লেখেন কাজ হবে না।

দ্বিতীয় পয়েন্ট, প্রথম পয়েন্টের সূত্র ধইরাই আসি। সুবর্ণা এইখানে খারাপ না ভালো আপনে জানেন না। আপনে তো হোল স্টোরি জানেন না। জাস্ট এক সাইডের একটা গল্প শুনছেন, তাও এক পপুলিস্ট লেখকের ভূমিকা মারফতে।

মানুষের বিবাহীত লাইফ ১০ বছরের হইলে, অনেক অনেক গল্প তো থাকে। চার পাঁচ লাইনের এক পক্ষের একটা শুইনা, কাউরেই জাজ করা যায় না, তাদের লাভ বা লাভহীনতারেও জাজ করা যায় না। সুতরাং, কে হিরো আর কে ভিলেন বা ভিলেনি এটা এখান থেকে বের করা অসম্ভব।

তৃতীয় পয়েন্ট, মানুষের বদলানোর যে প্রসঙ্গ এইটাতে আসি। সময় বদলায়, পরিবেশ বদলায়, মানুষের চাহিদা বদলায়। এর সাথে সাথে মানুষের আচরণ বদলাইতে পারে, এটা খারাপ কিছু না।

ধরেন আপনে বাজার থেকে এক বাক্স আপেল নিয়া গেলেন। এইরকম প্রতি সপ্তাহে নিয়া বাক্স খুইলা আপেল খান। সেইদিন বাড়িতে নিয়া দেখলেন আপেলগুলা সাপ হইয়া গেছে। এখন এই সাপগুলা তো আপনে ফেলে দিবেন? নাকি আপেল মনে কইরাই খাইয়া ফেলবেন! এই যে আপনার আচরণ বদল হইল, এটা আপনার সুখের জন্য বা সারভাইবালের জন্য। এতে খারাপ কিছু হয় না। ফলে সুজা সাবের ঐ বক্তব্যটারে এন্টায়রালি নেগেটিভ ধইরা নিলে হবে না। এডাপ্টেশনই যেহেতু প্রাণী হিসাবে আমাদের মূল একটা চালিকা শক্তি।

উপসংহারে, রোমান্টিক লাইফ বা পিরীত নিয়া ভাববাদী, পিটার প্যানীয় অবস্থান হইল অবাস্তব অবস্থান, যেইটাই মূলত এই গল্পরে পপুলার হইতে হেল্প করছে। বাস্তবের প্রেম সুন্দর আছে, নাইস আছে, সবচাইতে সেরা জিনিস মানুষের কিন্তু এইরকম না, প্রেম টিকাইয়া রাখতে একটা স্ট্রাগলও থাকে। প্রেমের সম্পর্কে মিলমিশের জায়গাটা বেশি ম্যাটার করে, বাকীগুলা অনুসঙ্গ, তরকারিতে এলাচের মতো। এলাচ বেশি হইয়া গেলে কামড়ে কামড়ে পড়তে পারে, সেইটা এক বাজে অভিজ্ঞতা, এবং এমন হলে তরকারীরে ভালো হইছে বলা যাবে না। ফালাইতেই হবে।

মুরাদুল ইসলাম